শুক্রবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২০

অন্তর্দাহ (ধারাবাহিক)

.                অন্তর্দাহ  
.                            রফিক উদ্দিন লস্কর
পর্ব-০১
তারিখ : ১৭/০৪/২০২০ইং
______________________________________________
শহরের ঠিক মাঝখানে সুরম্য তিনতলা বাড়িটি, নীচের তলার পূর্বদিকে  একটা সুন্দর ফুলবাগান। জুই, মালতী, গাঁদা, গোলাপ আর সূর্যমুখী বাড়ির সৌন্দর্য যেনো অনেকগুন বাড়িয়ে দিয়েছে।  দুপুর বারোটা, রোদটা যেনো ঘরের দেয়াল ডিঙিয়ে অন্দরমহলে হানা দিচ্ছে।  এমন সময় মোবাইলে একটা লম্বা রিং,  সুহানা হেঁসেলের কাজ মাঝপথে ফেলে  কলটা রিসিভ করলো। হ্যালো, কে?... আমি রাজেন। কোন রাজেন? আমি তো পুরো ধরতে পারছি না! হুম, সেই চেনা গলা, সুর একসময় অচেনা অজানা লাগে বলে রাজেন চট্ করে ফোনটা কেটে দিলো।
     সুহানা একটু ইতস্তত করে আবার কাজে  মনোনিবেশ করে। সকালের পড়ে থাকা সেই বাসনপত্তর একমনে বসে ঘসতেছে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে ফেলে আসা হাজার পুরোনো স্মৃতি বারবার তার মনের বারান্দায় পায়চারি করেছে। ঘরসংসার করে আজ আধবুড়ি। সুহানা সেই আগের মতো আর মিছেমিছি কোন বিষয় নিয়ে তেমন ভাবেনা। নিজের ছেলেপিলে এখন মানুষ করা এটাই সবসময় মাথায় ঘুরপাক খায়। একসময় সুহানা এমন ছিলো, বন্ধু বান্ধবীদের কোন একটা সমস্যা হলে সে নিজেই সেই সমস্যা নিয়ে গভীরভাবে ভাবতো এবং তার একটা নিতান্ত  সুরাহা বের করে দেওয়া  একটি নৈতিক দায়িত্বের মধ্যে ছিলো। স্কুল কলেজে পড়ার সময় সহপাঠীর একমাত্র বিশ্বস্ত বন্ধু সুহানা। স্নাতক শেষ করা মাত্রই বিয়ের পিড়িতে। মহা ধুমধাম, ডাক্তার বর। সে অনেক আগের কথা, তবুও যেনো চোখের সামনে লাইভ ভিডিওর মতো ভাসছে।
      এমন সময় রাসেল মা মা বলে ঘরে ঢুকলো, শনিবার তাই স্কুল থেকে একটু আগে বাসায় ফিরছে।  খা খা রোদে নরম শুভ্র ত্বক লাল কালচে। শরীরের শ্বেতাভ বসন ভিজে একাকার দেহের ঘর্মে। মা আজ অন্যরূপী, মা ডাকটা যেনো আজ আর কানে বিশেষভাবে প্রতিধ্বনি দেয়নি। রাসেল হঠাৎ গিয়ে মায়ের আঁচল ধরে সজোরে একটা টান দিলো,  সুহানা পাথর থেকে জলের মতো হয়ে রাসেলের দিকে তাকিয়ে বললো, আজ এত্তো সকাল সকাল ফিরলি টিউশনে যাস্ নি? মা... আজ শনিবার তোমার মনে নেই? অহও! আয় ড্রেস বদলিয়ে দেই। বাথরুমে গিয়ে একটু ফ্রেস হয়ে আয়, আমি রান্নার কাজটা শেষ করি।
      রাসেল ফ্রেস হয়ে বৈঠকখানায় এসে টিভির রিমোট হাতে নিয়ে টিভিটা অন করলো,  তার ফেভারিট চ্যানেল পগোতে যেনো নিজেকে বিলীন করে দিলো।  সামনের টেবিলে রাখা মায়ের মোবাইল,  হঠাৎ  একটা মিসকল!  ট্রু কলারে ভেসে উঠছে একটা নাম লাবনী। সে মোবাইলটা হাতে নিয়ে মায়ের কাছে দৌড়ে গেলো।, মা মা একটা মিসকল এসেছে,  নাম দেখাচ্ছে লাবনী।  সুহানা সেই নাম্বারে কলব্যাক করলো, অপর প্রান্ত থেকে প্রত্যুত্তর... আমি মামনির মিস্ বলছি। মামনির কলেজ কয়েকদিনের জন্য ছুটি লকডাউনের কারণে। এত্তো দূর যাওয়া সম্ভব নয়, ট্রেন চলাচল একদম বন্ধ, তবে চিন্তা করোনা ও আমার এখানে থাকবে এ ক'দিন। মিনিট দু'য়েকের মধ্যে ফোন বিচ্ছিন্ন হলো কারণ জিও নেটওয়ার্ক!..

পর্ব -০২

  সুহানা ভাবনাগ্রস্ত হয়ে পড়লো, কি করা যায়! এ ক'দিন থেকে ডাক্তারবাবু (রাজীব) ও ঘরে ফিরছেন না। একমাত্র সম্বল রাসেলকে নিয়ে এই বিশাল অট্টালিকায় দিন কাটছে। এদিকে বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে দেশের যা অবস্থা তাতে কোন সময় কি হয় বলা মুশকিল।  শহরের মোড়ে মোড়ে পুলিশ,  মাঝে মাঝে সাইরেন বাজিয়ে ঝড়ের ন্যায় ছুটছে এম্বুলেন্স। টিভিতে সাংবাদিকের  উচ্চস্বর, ব্রেকিং নিউজ! নির্জনতা যেনো ছায়া ফেলেছে ব্যস্ততম শহরে, শপিং মল, রেস্তরাঁয় শাটার ফেলানো। বাইকারসদের দৌরাত্ম্য, চায়ের দোকানে বসে কতো আড্ডা, রাজনীতির গল্প এসব এখন অমাবস্যার চাঁদের মতো। সকাল হলে ফেরিওয়ালার চর্বণীয় আওয়াজ শোনা যায় না। জীবন বাজি রেখে মাঝে মাঝে লুকিয়ে লুকিয়ে আসা দু'এক সব্জিওয়ালা, তাও পুরোনো বাসি সব্জি।
   রাসেল ক্লাস সিক্সে পড়ে, স্কুল বন্ধ থাকায় সে এখন মায়ের  সহচর। না হলে তো সকাল আটটা থেকে চারটা পর্যন্ত ও নিজের স্কুল আর টিউশন নিয়ে  ব্যস্ত । রাজীববাবু সেই আগের মতো আর ফোন করেন না, করলেও দেড় দু'মিনিট সময় গত হয়। হাসপাতাল গুলোতে যেনো নবান্নের উৎসব। কড়া নজরদারি, তাছাড়া যেসব  রোগীরা আসেন ওদের পরিচর্যাকারী আপন কেহ আসেনা। ওরা স্বেচ্ছায় নির্বাসিত আপনজন আর মাতৃভুমির জন্য।
      সুহানা কুঁকড়ে গেছে ভয় আর আতংকে। চোখে নিয়মিত সর্ষে ফুল।  স্বামী, মেয়ে, আত্মীয়ের সাথে শুধুমাত্র ফোনে আলাপ। কেউ বেড়াতে আসেনা, আসবেবা কি করে!? পাশের বাসার রুনু মাসি ও ক'দিন থেকে একঘরে হয়ে গেছেন। নাহলে তো সেই  সকালে চায়ের কাপের নিত্য দাবিদার থাকতেন।  রুনু মাসির একমাত্র ছেলে ব্যাংগালুরুতে কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনা করে সেখানে সেও আটকে আছে অনির্দিষ্ট কালের জন্য। নিজের আর আত্মীয় পরিজনের সংকটকালে সুহানা কোন পথে যাবে নিজেই ভেবে পায়না। কালবৈশাখী বিকেলের মতো অন্ধকারে ছেয়ে গেছে চারপাশ,  নিজের মনের কথা ভাগাভাগি করে নেওয়ার মানুষজন আজ এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপের বসবাসকারী। রাতে ঘুমোতে গেলেও দুঃস্বপ্ন এসে ভিড় করে চোখের সীমানায়। মাঝরাতে আঁৎকে উঠে ঘুম থেকে ঝিঁঝিঁ পোকা আর ঘাড়ো ব্যাঙের কোরাস ডাক কর্ণকুহরে ঢোকে মনে করিয়ে দেয় সোমালিয়ার অভুক্ত শিশুর মৃত্যু চিৎকার।...
১৮/০৪/২০২০ইং

পর্ব- ০৩
১৯/০৪/২০২০ইং
  ঘরে মজুত রসদ প্রায় শেষ হওয়ার পথে, আশপাশের অসহায় মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে গিয়ে অনেকটা কমে গেছে। তাতে কি! বিন্দুমাত্রও আফসোস নেই সুহানার। মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে পারলে তার মন আত্মায় তৃপ্তি আসে আর এটাতে যে সর্বসুখ।
আজ বুধবার,  সুহানা খুব প্রাতে শয্যা ত্যাগ করে, হাতমুখ ধোয়ে তারপর ঈশ্বর আরাধনার কাজটা সম্পন্ন করে। তারপর চা,  সকালের নাস্তা রেডি করে রাসেলের ঘুম ভাঙান। চোখ কচলে কচলে রাসেল মাকে জিজ্ঞাসা করে,  "বাবা আসেননি?" একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে মা বললেন, কি করে আসবেন বল্?  হাসপাতালে রাতদিন ডিউটি তাছাড়া যে কেওয়ের সাথে ঘুরাফেরা উঠাবসায় ও লাগাম। সেদিন ফোন করে বলেছেন আগামী ২১তারিখ ঘরে ফিরবেন। রাসেল ম্লানমুখে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে, টপটপ করে কয়েকফোটা অশ্রু গাল বেয়ে নীরবে পড়তে থাকে। জন্মের পর থেকে সে এই প্রথম এতোদিনের জন্য বাবার স্নেহ আদর থেকে বঞ্চিত। খাঁচায় বন্দি পাখির মতো চটপট করতে থাকে রাসেল। বাবার আদর স্নেহ থেকে সে নিজেকে বিচ্ছিন্ন রেখে নিজেকে বড্ড অসহায় বোধ করছে। বাড়ির বারান্দায় বসে সকাল দুপুর,  নির্জন নীরবতার ভয়ংকর চিত্র গ্রীলের ফাঁক দিয়ে যেনো সবসময় তাড়া করছে।  পথচলতি মানুষের হাঁকডাক, গাড়ির আওয়াজ, এসব যেনো কোন এক সাগরের অতলে লুকিয়ে আছে।
বেলা বারোটা, মধ্যাহ্ন ভোজন রেডি করে মা রাসেলকে ডাক দিলেন।  রাসেল! রাসেল!  এসো বাবা! খাবার খেয়ে নেই। মায়ের ডাকে  রাসেল ডাইনিং টেবিলের পাশে গিয়ে বসে। আজ তিনটি চেয়ার ফাঁকা, খেতে গিয়েও সে একাকীত্ব বোধ করে। অন্যান্য দিন রুনুমাসি ও থাকতেন, রূপকথার গল্প - হাসিঠাট্টায় জমতো টেবিল। এমন সময় ঘরের মোবাইলে একটা লম্বা রিং,  রাসেল ফোনটা রিসিভ করলো, হ্যালো! বাবা কবে আসছো?  এই তো ব্যাটা, দু'একদিনের মধ্য আসছি। তুমি কেমন আছো রাসেল? কেঁদো কেঁদো সুরে ভালো আছি। রাসেল ফোনটা মায়ের হাতে দিলো। হ্যালো, কেমন আছো? কবে আসছো?  অপ্রান্ত থেকে কোমলসুরে, তুমি চিন্তা করোনা...আমি চৌদ্দদিন পরে বাসায় আসছি। আর হ্যাঁ, এক'টা দিন সাবধানে থেকো। বাইরের কারো সাথে দেখা সাক্ষাৎ করোনা কিন্তু।  আর রাসেলের খেয়াল নিও, ওকে খুব খুব মিস করছি বলে লাইনটা কেটে দিলেন।
খাবার শেষ করে আজ সুহানা যেনো একটা অস্বস্তিবোধ করছে। সময় আজকাল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। পরিবার পরিজন, আত্মীয় শুধুমাত্র ফোনালাপে একত্রিত হন। নয়নভরে দেখার মতো কাউকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।  অজানা আতংক সবসময় ঘিরে আছে চারপাশ। কবে অবসান হবে  নিঃসঙ্গতার। কবে স্বাভাবিক ভাবে  ফিরে আসবে পিরিস্থিতি! রুজি রুটির তাগিদে কবে বেরুবো মানুষ!... এসব ভাবতে ভাবতে একসময় সুহানা ঘুমিয়ে পড়ে।...

ক্রমশঃ-

কোন মন্তব্য নেই:

খোকন রাজা

খোকন রাজা   রফিক উদ্দিন লস্কর  খেলার ছলে  ছোট্ট খোকন ভাবতো নিজেই রাজা, সে পোকা মাকড় ধরে এনে দিতো খুবই সাজা। কেউ কখনো বললে কিছু করতো খুবই রাগ...